আমি প্রতিদিন ঘুরে বেড়াতাম নিজ গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে। গ্রামটা ছিল বিশাল তাই হাঁটতে হাঁটতে পড়ন্ত বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসত। মেঠো পথের পাশেই ছিল একটি হিন্দু বাড়ি আমি প্রতিদিন খেয়াল করতাম সন্ধ্যায় আজানের সুমধুর সুর শোনার ঠিক পর মুহূর্তে ঐ হিন্দু বাড়িতে নববধূর উলুধ্বনি কাশীর টং টং শব্দ, তার পরই কাশি ও করতালের মিশ্রণে ভিন্ন একটি শব্দ শোনা যেত যা নিজের কাছে ভালোই লাগত। এরই সাথে নতুন বউ এর গুঞ্জন ধ্বনি ও শুনতাম। ঐ মেঠো পথ বেয়ে প্রতিদিন ছিল অনেক লোকের আসা যাওয়া। সারা গ্রামের মধ্যে শশী মোহনের বাড়ি টাই ছিল একমাত্র হিন্দু বাড়ি বাদ বাকি সবটিই আমাদের। আমি কোন কাজ ব্যতীত তেমন একটা আসা যাওয়া করতাম না এদিকে তবে সন্ধ্যাকালীন ঐ বাড়ির সব দৃশ্যই জানতাম। ঐ বাড়িতে বৃদ্ধ শশী মোহন, তার ছেলে ও পুত্রবধূ বাস করতেন। আজ আমি তাদের বাড়ির পাশে দাঁড়ালাম !! বৃদ্ধ পিতা: বউ এক কাপ চা দাও? ঠিক আছে বাবা উত্তরে বউ। হঠাৎ অদূর মসজিদের মোয়াজ্জিন শশী মোহনের বাড়িতে ঢুকলেন ও রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন “বাবু শশী মোহন বাড়িতে আছেন?” শশী: কে? আমি আব্দুল মোয়াজ্জিন । ও এদিকে আসেন, বারান্দায় বসেন। না, আমি বসতে আসি নি আব্দুল গলার জোর বাড়িয়ে বললেন, আজ আমি শেষ বারের মত বলতে এসেছি আর কোন দিন যদি মাগরিবের আযানের পর তোমার বাড়িতে কোন শব্দ হয় এবং সেই কারণে যদি আমাদের নামাজের ব্যাঘাত ঘটে তাহলে তোমাদের পরিণতি হবে করুণ। কথাটা মনে থাকে যেন? শশী মোহন নীরবে চুপ হয়ে রইল, একটি কথাও বের হলো না তার, কারণ এটা যে মুসলমানদের গাঁ, এই কথার উপর একটি ও কথা বলার অধিকার নেই তার। কোন কিছু বলে ফেললে কথায় কথা বেড়ে অহেতুক কোন কান্ড বাধিয়ে দেয়, সেই ভয়ে শশী নীরবে মাথা নিচু করে রইল। আব্দুল: কথা কানে যায় না শশী ? কিছু বলছ না যে? শশী কি বলবে তার চৌদ্দ পুরুষ থেকে শুরু করে পিতামহ, পিতা পর্যন্ত তাদের মায়েবা সন্ধ্যাকালীন সময়ে সন্ধ্যা আরতি করে আসছেন, এটা যে ধর্ম এই সন্ধ্যা আরতি বাদ দেয়া যে ধর্মের প্রতি চরম অবমাননা। শশী কিছু বলতে পারছে না কিংবা সইতে পারছে না, এই অকাল মূহুর্তে কিছুই করার ছিল না তার। তখনও শশী নীরব হয়ে রইল। ঘরের চারিদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকাগুলি গভীর বেদনায় ডেকে উঠলে সেখানে এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি করল যেন মনে হচ্ছিল, মনুষ্যহীন পৃথিবীটা তার আসল রূপ ফিরে পেয়েছে। আব্দুল মোয়াজ্জিন নীরব শান্ত পরিবেশ আবারও অশান্ত করে তুলল। আব্দুল বলে -শশী আগামীকাল থেকে যেন তোমার বাড়িতে নামাজের সময় যেন কোন শব্দ না হয়, নামাজের ব্যাঘাত ঘটলে তুমি সহ তোমার পরিবারকে গ্রাম খেকে চিরতরে বিদায় নিতে হবে। আমি আর এই ভাবে আসব না! কথাটা মানে থাকে যেন। এই বলে আব্দুল মোয়াজ্জিন শশীর বাড়ি থেকে বের হতে লাগল। আকৎস্মা বাড়ির উঠানের একেবারে শেষ প্রান্তের তুলসী গাছটা তার চোখে পড়লে সে তুলসী গাছটা হাত দিয়ে উপড়ে ফেলল এবং স্বহস্থে গাছটি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুরে কোথাও ফেলে দিল। তুলসী গাছটা উপড়ে ফেলার সময় বউ বৃদ্ধ পিতার কাছে কি যেন বিড় বিড় করে বলতে লাগল। বৃদ্ধ পিতা বউ এর দুহাত ধরে নীরবে চুপ হয়ে রইলেন। তখন তাদের চোখের দ্বার দিয়ে বেদনাশ্রু আষাঢ়ের অঝর ধারার মত ঝরতে লাগল। যা দেখে আমিও নিজেকে সামলাতে পারলাম না। পরদিন বিকেল বেলা বউ ঘরের পিছন থেকে আরেকটি ছোট্ট তুলসীর চারা এনে মেদিতে রোপণ করে গোঁড়ায় জল ঢেলে দিলেন। জল পেয়ে চারাটি টগবগ করে বেড়ে উটতে শুরু করল। শশী মোহনের বাড়িতে ছিল একটি বকনা গরু। মানুষের তাড়নায় আর অভাবের কালো স্রোতে কখনই সেটা ভেসে গেছে। টাকা ও দেখাশোনার অভাবে শশী তার বকনাটি তার পাশের গ্রামের ব্যাপারীর কাছে বিক্রি করে। তাও সে সঠিক মূল্য পায় না। বকনাটি থাকা কালীন প্রতিদিন প্রায় ৪-৫ জন লোক রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়ার সময় মিথ্যাই নালিশ করত। যদি কোনদিন বকনাটি কারো ফসল নষ্ট করত তাহলে তাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ত। ছোট বড় ব্যতিরেকে সবাই মুখ দিয়ে যা আসত তাই বলত শশীকে। আবার অনেকে সদুপদেশ হিসেবে বকনাটি বিক্রির কথা বলত। শশীর দেরী হলনা তাদের অসৎ উদ্দেশ্য বুঝতে। যে আসন্ন কোরবানির ঈদে বকনাটি কোরবানির নির্মম জবাই হতে পারে ঐ কথা মাথায় রেখে সে বকনাটি বিক্রি করেনি। অনেকে ঈদের চার মাস পূর্ব হতে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত শশীর বাড়িতে তারা বকনাটির ব্যাপারে আসা যাওয়া নানা কথা বলত। কিন্তু শশী রাজী না থাকায় বকনাটি জবাইয়ের হাত থেকে বেঁচে যায়। অতঃপর শশী ঈদের কয়েক মাস পর বকনাটি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কিছুদিন পর শশী তার ছেলেকে বাজার থেকে মাছ আনতে বলল। আচ্ছা বাবা আনব উত্তরে ছেলে। বৃদ্ধের সহজ সরল ছেলেটি প্রতিদিন সকালে বাজারে যায় আর রাতে বাড়ি ফেরে। পিতার কথা মত খোকা বড় মাছ আনল। বৃদ্ধ পিতা বললেন, “বউ আজ আমার জন্য বড় করে দু টুকরো মাছ ভাজি করে দিও”। বউ পরম মমতায় রান্না বান্না সেরে পরিবেশন করলেন রাতে আহারের পর তিন জনই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ঠিক তখনই একটি কুচক্রী মহল সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জের ধরে ভোর রাত্রিতে তাদের ছোট্ট ঘরের চারিদিকে আগুন ধরিয়ে দিল। মূহুর্তে সবকিছু জ্বলে পুড়ে ছাই!!!! বৃদ্ধের ছেলে ও ছেলের বউ কোন রকমে প্রাণে বাঁচলেও বৃদ্ধ পিতা সহিংসতার দাবানলে ছাই হয়ে যায়। স্বামী স্ত্রীর কান্নায় আসে পাশের পরিবেশটা ভারি হয়ে উঠল। মনি যুগলের আর্তনাদে পথের পথচারীরা থেকে শুরু করে স্বর্গের দেব দেবীগণ পর্যন্ত অশ্রুজল ধরে রাখতে পারেন নি। নির্বাক প্রাণহীনের মত জরাজীর্ণ , শীর্ণ, বিবর্ণ হয়ে গেল যুগলের মুখখানি। এরপর থেকে ঐ বাড়িতে আর কোন দিন কাশি করতালের মিশ্রণ শব্দ এমনকি নববধূর উলুধ্বনি কিংবা গুঞ্জন ধ্বনি ও শুনতে পাইনি!!! আমি এখনো নির্বোধের মত দাড়িয়ে আছি ঐ বাড়ির পাশেই ইতিহাসের নির্বাক সাক্ষী হয়ে। আর ভাবতেছি এর জন্য কে দায়ী??????
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আখতারুজ্জামান সোহাগ
সংখ্যালঘুদের জীবন, নানা ছল-ছুতায় তাদের উপর আক্রমণ, প্রতিহিংসার লেলিহান শিখায় ভস্ম হওয়া মানবতা- সবই উঠে এসেছে গল্পে। ছোট পরিসরে দুর্দান্ত একটা গল্প পড়লাম। শুভকামনা গল্পকারের জন্য।
মোজাম্মেল কবির
বেশ কয়েকটি বাক্যে একাধিক বার একই শব্দ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে চলে এসেছে। সেদিকে একটু খেয়াল রাখতে হবে। গল্পের প্লট খুব সুন্দর। শুভ কামনা রইলো...
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।